করোনায় বন্দি অর্থনীতি

আহসান উল ফেরদৌস:

সারা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে করোনার ভয়াল থাবা ।চীনের উহানে উৎপত্তি হয়ে প্রায় প্রতিটি দেশে ছড়িয়ে ভয়াবহ তান্ডবলীলা চালিয়ে যাচ্ছে মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমিত এ ভাইরাস । ইউরোপের দেশগুলো এ ভাইরাস এতটাই প্রাণঘাতি হয়ে দাড়িয়েছে যে, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানগণ আকাশের দিকে তাকিয়ে সমাধান খুঁজছেন ।

কিছুদিন আগেও যেখানে পুরো বিশ্বকে একটি গ্রামের সাথে তুলনা করা হতো সেখানে আজ প্রতিটি দেশই সীমান্ত বন্ধ করে দিচ্ছে ; এমনকি একই দেশের অভ্যন্তরে একটি শহর থেকে আরেকটি শহর বিচ্ছিন্ন রেখে মানুষে মানুষে সঙ্গনিরোধকেই এর একমাত্র সমাধান মনে করা হচ্ছে ।

সারাবিশ্বের মত বাংলাদেশেও এর প্রবেশ রোধ করা সম্ভব হয়নি । আশার কথা, এখন পর্যন্ত (২৯.০৩.২০২০) বাংলাদেশে এর ক্ষয়ক্ষতির কিংবা প্রাণসংহারের পরিমাণ তুলনামূলক কম । তবে অর্থনীতিতে এর প্রভাব দৃশ্যমান । বাংলাদেশের রপ্তানী বানিজ্যের সিংহভাগ তৈরী পোশাক খাতের অবদান । সে খাত মারাত্মক ভাবে হুমকির মুখে । ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় করোনার প্রভাব সর্বোচ্চ হওয়ায় এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের ৮৪ টি পোশাক কারখানার প্রায় ১০ কোটি মার্কিন ডলার সমমূল্যের ক্রয়াদেশ বাতিল হয়েছে (প্রথম আলো ১৯ মার্চ,২০২০), যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৮৫০ কোটি টাকার সমপরিমাণ, যা আরো বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে ।

৪ এপ্রিল পর্যন্ত সারাদেশে সাধারণ ছুটি চলমান । এর মধ্যে পরিস্থিতির উন্নতি না হলে যদি ছুটি আরো বাড়ানো হয়, তবে তা আরো বিশাল ক্ষতি বয়ে নিয়ে আসবে; বিশেষত বাংলা নববর্ষকে ‍কেন্দ্র করে যে বিশাল বানিজ্য হতো, তা ব্যাপকভাবে ব্যাহত হবে ।২০১৯ সালে বাংলা নববর্ষে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার পোশাক ও অন্যান্য সামগ্রী বিক্রি হয় (প্রথম আলো -১৪ এপ্রিল,২০১৯ খ্রি.)। এটি নি:সন্দেহে পোশাক প্রস্ততকারী এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এমনকি ফুলের ব্যবসার জন্যও নেতিবাচক প্রভাব বয়ে আনবে । ইতোমধ্যে আমাদের পর্যটন ব্যবসা স্থবির ।

মানুষ ঘরে থাকায় এবং সরবরাহ ব্যবস্থায় ব্যাঘাত সৃষ্টি হওয়ায় কৃষি পণ্যের চাহিদাও কমে গেছে । যেহেতু কৃষিপণ্য পঁচনশীল, এমতাবস্থায় সবজি চাষীরাও বিপাকে পড়তে পারেন । ক্ষুদ্র চাষ অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, গত ১০ দিন আগে যেখানে মরিচের পাল্লাপ্রতি পাইকারি মূল্য ১২০ টাকা (কালিগন্জ্ঞ , লালমনিরহাট) ছিল, আজ তা কমে ৪০ টাকা মাত্র । এ অবস্থায় কৃষি পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা যাতে ভেঙে না পড়ে সেজন্য বিশেষ উদ্যোগ নেয়া যায় কিনা ভেবে দেখা দরকার । একটি বাজারের নির্দিষ্টি স্থান ছেড়ে শহরের রাস্তা কিংবা গলিতে অস্থায়ী দোকান (নির্দিষ্ট সময়ের জন্য)কিংবা ভ্যানে পণ্য সরবরাহ বাড়ানো উৎসাহিতকরণ একটি সমাধান হতে পারে । ইতোমধ্যে বাংলাদেশ পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থা এমন প্রশংসনীয় উদ্যোগ গ্রহন করেছে ,তবে তা আরো বাড়ানোর ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়া দরকার ।

সরকার গৃহীত সঙ্গনিরোধ সহ অন্যান্য পদক্ষেপ যদি করোনার বিস্তার রোধে সক্ষম হয় ও, আমাদের এর পরবর্তী অর্থনৈতিক বিপর্যয় সম্পর্কে এখনোই চিন্তা করার সময় । উল্লিখিত খাতগুলোতে কর্মরত বিপুল সংখ্যক নিম্ন আয়ের শ্রমিকদের খাদ্য সরবরাহ ও জীবনমান নিশ্চিতে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে । ব্যবসা বানিজ্য সম্প্রসারণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নির্দেশিত ”সিঙ্গেল ডিজিট” সুদহার কার্যকর সহ নতুন বাজার সন্ধান করতে হবে । এছাড়াও পরবর্তী মুদ্রানীতি কেমন হবে সেটিও ভাবতে হবে । এ বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে সরকারের পাশাপাশি সমাজের বিত্তবানরা যদি এগিয়ে আসেন এবং সাধ্যমতো একটি করে দরিদ্র পরিবারকে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করেন, তবে হয়তো সমন্বিতভাবে এ দূর্যাগ কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।

লেখকঃ প্রভাষক, অর্থনীতি বিভাগ, কারমাইকেল কলেজ, রংপুর