কর্মক্ষেত্রে ব্রেস্ট ফিডিং রুমঃ কর্মজীবী মায়েদের প্রত্যাশা

শান্তা ঊর্মিলা মৌ | বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা)

মাতৃত্বকে বলা হয় নারী জীবনের সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ, অথচ সেই মা ই যখন তার নবজাতককে মাতৃদুগ্ধ পান করাতে গিয়ে বিড়ম্বনার শিকার হন তখন নিজেকে সবচেয়ে অসহায় হিসেবে সে আবিষ্কার করে।

কথা বলছি ঘরের বাইরে মায়েদের নিরাপদ মাতৃদুগ্ধ দানের স্থান না থাকা নিয়ে। খাদ্যের চাহিদা পৃথিবীর সব মানুষের মৌলিক চাহিদা। মৌলিক মানবিক চাহিদার দুটি ভাগের মাঝে খাদ্য মৌলিক চাহিদার অন্তর্ভুক্ত। মার্কিন সমাজকর্ম গবেষক Charlotte Towle এর “Common Human Needs” গ্রন্থে ছয়টি মৌলিক মানবিক চাহিদার উল্লেখ করে তার মাঝে খাদ্যকে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ চাহিদা বলে উল্লেখ করেছেন। স্বভাবজাত প্রবৃত্তি ও প্রকৃতি হতে সৃষ্ট এসব অনন্য ও চিরন্তন মৌলিক চাহিদা পূরণ রাষ্ট্র ও সমাজের অবশ্য করণীয়।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দেশে কিংবা অঞ্চলভেদে মানুষের খাদ্যের তালিকা, ঐতিহ্য ও অভ্যাসগত পার্থক্য থাকলেও পৃথিবীর সব শিশুর ক্ষেত্রে জন্মের পর মাতৃদুগ্ধ সর্বজনীন এক খাবার যার উপর নির্ভর করে শিশুর দৈহিক ও মানসিক বৃদ্ধি এবং বিকাশ। শিশুদের ডায়রিয়া, ফুসফুসের প্রদাহ ও শ্বাসকষ্টজনিত রোগ থেকে রক্ষা পেতে মাতৃদুগ্ধ পানের বিকল্প নেই। অথচ ঘরের বাইরে সেই শিশুর জন্য নেই তেমন কোনো নিরাপদ মাতৃদুগ্ধ দানের স্থান। যাত্রাপথে বা শপিংমলে বা কর্মক্ষেত্রে যেখানে ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার নেই সেখানে একজন মা কে এমনভাবে তার শিশুকে দুধ পান করাতে হয় যেনো তিনি কোনো অপরাধ করছেন। যাত্রাপথে একটা শিশুর খাদ্যের চাহিদা সৃষ্টি হলে পৃথিবীর কোনো কিছু দিয়েই সেই অবুঝ শিশুকে শান্ত করা সম্ভব হয় না।

ধূমপানের জন্যও পরিণত বয়সের লোকদের স্মোকিং জোন থাকে অনেক জায়গায়, কিন্তু অপরিণত মনের শিশুদের থাকে না দুগ্ধপান এর জোন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী দেশের ১ কোটি ৬২ লাখ কর্মজীবী নারী রয়েছেন। সরকারি বেসরকারি চাকরি থেকে শুরু করে বিমানের পাইলট, সেনাবাহিনী ও অন্যান্য ক্ষেত্রে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নারী নিয়োগের ক্ষেত্রে ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেছেন। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৫তম বার্ষিক অধিবেশনে ফোর্থ ওয়ার্ল্ড কনফারেন্স অন উইমেনের ২৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৪১ সাল নাগাদ কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ ৫০-৫০ এ উন্নীত করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। এভাবে আমাদের নারী উন্নয়নে যেমন নারীকে কর্মক্ষেত্রে সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে তেমনি কর্মজীবী নারীর সন্তানদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ও সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসতে হবে।

মনে রাখতে হবে প্রতিটি কর্মজীবী নারীই একসময় মা হবেন,সেই মায়ের সন্তানের খাদ্যের চাহিদা পূরণের সঠিক ব্যবস্থা কর্মক্ষেত্রে না থাকলে নারী কর্মজীবীরা সঠিকভাবে তাদের কর্মক্ষেত্রে মনোনিবেশ করতে পারবেন না। সরকারিভাবে মাতৃত্বকালীন ছুটি ১৮০ দিন পাওয়ায় নবজাতকের জন্মের পর এই কদিন কর্মজীবী মায়েরা নিশ্চিন্ত থাকতে পারলেও বিপত্তি বাঁধে কর্মস্থলে যোগদানের সময় হতে।কারণ সরকারিভাবেও সকল সরকারি প্রতিষ্ঠানে ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার নেই,নেই বেবি কেয়ার সেন্টার। তবে বিষয়টি কেবল নারীর কর্মক্ষেত্রের জন্য নয় যেকোনো গৃহিণী যিনি একজন সন্তানের মা তার ও অধিকার আছে ঘরের বাইরে গেলে সে যেনো তার সন্তানকে নির্বিঘ্নে মাতৃদুগ্ধ পান করাতে আরেন সেরকম নিরাপদ পরিবেশ পাওয়ার।নতুবা স্বীকার করতে হবে সন্তান জন্মদানের পর মায়েরা প্রয়োজনে বাইরে যাবে এ অনুমতি আমাদের রাষ্ট্র বা সমাজ আমাদের থেকে কেড়ে নিচ্ছে।

তাছাড়া যেসকল মায়েদের তাদের সন্তান অফিস চলাকালীন সময়ে দেখাশোনার কেউ নেই তাদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থার ও চিন্তা করতে হবে। সকল কর্মজীবী মায়ের তাদের সন্তান বাসায় রেখে আসা সম্ভব না ও হতে পারে। উন্নত বিশ্বে এক্ষেত্রে ডে কেয়ার সেন্টার এর ব্যবস্থা আছে । অবশ্য আমাদের দেশে ডে কেয়ার সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা ও ভ্রান্ত তথ্যের ছড়াছড়ি মাত্রাতিরিক্ত। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক চিকিৎসা বিষয়ক সাময়িকি JAMA Psychiatry র এক গবেষণা অনুযায়ী সর্বক্ষণ বাসায় অবস্থান করা শিশুদের তুলনায় ডে কেয়ারে সময় কাটানো শিশুরা আবেগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা বেশি অর্জন করে।অনেক শিশু ও মানুষের মাঝে থাকার কারণে তাদের সামাজিকতা, ভাষার দক্ষতা, সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা অন্যান্য শিশুর চেয়ে বেশি থাকে। সেসব দেশে কেবল কর্মজীবী মায়েরাই তাদের সন্তানদের ডে কেয়ার সেন্টারে পাঠান বিষয়টি সেরকম নয়, অন্যান্য মায়েরাও মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক বিকাশের জন্য শিশুদের দিনের নির্দিষ্ট সময় সেসব প্রতিষ্ঠানে রাখেন। বাংলাদেশে একটা প্রতিবন্ধকতা হতে পারে ডে কেয়ার সেন্টার এ সেবা দেয়ার জন্য এখানে যথেষ্ট প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই যেটা অত্যাবশকীয়।

আমাদের দেশে এখন ও বাচ্চার যত্ন লালন পালন এসব বিষয়ে মা কেই সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব পালন করতে হয়,এই অনুশীলনটা আসলে পরিবার থেকেই মানসিকভাবে গেঁথে দেয়া হয়। তাই কর্মজীবী মায়েদের তাদের সন্তান নিয়ে পড়তে হয় বাড়তি চিন্তায়। হয়তো পরিবারে অন্যান্য সদস্য আছে কিন্তু সন্তানের সব কাজ একা সেই মায়েরই করতে হয়।আর বাইরের বিশ্ব সম্পর্কে আমরা প্রচুর ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে ছোটোবেলা থেকেই বড় হই, যেমন – ইউরোপ আমেরিকায় ঘরে ঘরে ডিভোর্স হয়, সেখানে সবাই সিংগেল মাদার, তাদের নানা,নানি,দাদা, দাদি নেই বা পরিবারের বন্ধন ভালো না। অথচ তাদের মাঝে একসাথে মিলেমিশে থাকার নজির বাংলাদেশের গ্রামীণ পরিবারের চেয়েও ভালো অনেক ক্ষেত্রেই।যুক্তরাজ্যভিত্তিক চিকিৎসা-বিষয়ক গবেষণা সাময়িকী দ্য ল্যানসেটে প্রকাশিত প্রবন্ধ অনুযায়ী দীর্ঘদিন ধরে বুকের দুধ পান করানো সন্তানের মায়েরা বিশ্ব অর্থনীতিতে ৩০০ বিলিয়ন ডলার বাঁচাচ্ছেন।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও পুরুষের পাশাপাশি নারীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। তাই অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারীকে সম্পৃক্ত রেখে নারীর শতভাগ মেধা কাজে লাগাতে কর্মজীবী মায়েদের সন্তানদের বিষয়টি বিবেচনায় রাখার বিকল্প নেই। অবশ্য ২০১৯ সালে উচ্চ আদালতে রিটকারী নয় মাসের শিশু উমাইর বিন সাদী ও তার মা আইনজীবী ইশরাত হাসান এর রিটের ভিত্তিতে সব প্রতিষ্ঠানে ‘মাতৃদুগ্ধ দান কক্ষ ও বেবি কেয়ার কর্নার’ করতে হাইকোর্টের রুল জারি করে।

যদিও শিশুর এই চাহিদা রিট করে আদায় করাটা খুবই দুঃখজনক। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায়ও শিশুকে মায়ের দুধ খাওয়াতে কর্মজীবী মা এর জন্য উপযুক্ত পরিবেশ প্রদান করতে সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, বিমা-ব্যাংক, শপিংমল, কল-কারখানা, পেশাজীবী সংগঠন, ট্রেড ইউনিয়ন ও মানবাধিকার সংগঠনসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে এগিয়ে আসতে উল্লেখ করা হয়েছে তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার।

পাশাপাশি ‘বাংলাদেশ শ্রম আইন-২০০৬’র এর ‘শিশু কক্ষ’ সংক্রান্ত ৯৪ (৭) ধারায় বলা হয়েছে, ‘উক্তরূপ কোনো কক্ষ যথেষ্ট আসবাবপত্র দ্বারা সজ্জিত থাকিবে এবং বিশেষ করিয়া প্রত্যেক শিশুর জন্য বিছানাসহ একটি খাট বা দোলনা থাকিবে এবং প্রত্যেক মা যখন শিশুকে দুধ পান করাইবেন বা পরিচর্যা করিবেন, তখন তাহার ব্যবহারের জন্য অন্তত একটি চেয়ার বা এই প্রকারের কোনো আসন থাকিতে হইবে এবং তুলনামূলকভাবে বয়স্ক শিশুদের জন্য যথেষ্ট ও উপযুক্ত খেলনার সরবরাহ থাকিতে হইবে।’ কিন্তু সর্বক্ষেত্রে এসব আইন ও নির্দেশনার দ্রুত বাস্তবায়ন জরুরি।

ইতোমধ্যে মাগুরার চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো: জিয়াউর রহমান জিয়ার উদ্যোগে মাগুরা আদালত চত্বরে মাতৃছায়া ব্রেস্ট ফিডিং কর্ণার চালু হয়েছে এবং ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন এর মেয়র আতিকুল ইসলাম জানিয়েছেন তার অধীনে সিটি কর্পোরেশন এর নতুন মার্কেটগুলোতে ব্রেস্টফিডিং কর্নার চালুর কথা উল্লেখ আছে। কিন্তু শুধু ঢাকা কিংবা মাগুরাতেই নয় প্রতি জেলাতেই আছেন মা এবং তাদের দুগ্ধ পানকারী শিশু।

তাই দেশের প্রতি জেলায় এবং সরকারি বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানে নিরাপদ মাতৃদুগ্ধ দানের স্থান বা ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার চালু করা উচিত। একই সাথে বাংলাদেশে ডে কেয়ার সেন্টার চালুর জন্য প্রশিক্ষিত কর্মী তৈরি করাও এখন সময়ের দাবি। আজকের শিশু আগামী দিনের রাষ্ট্র পরিচালনার ভূমিকা পালন করবে। তাই শিশুর সঠিক বৃদ্ধি ও বিকাশে শিশুর অত্যাবশকীয় চাহিদা পূরণ করা তথা শিশুর মায়ের মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে আশেপাশের সবাইকে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে হবে। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে একজন কর্মজীবী মা হিসেবে বাংলাদেশের সব মায়ের পক্ষ হতে এই প্রত্যাশা রাখছি।

লেখকঃ প্রভাষক, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ
পটুয়াখালী সরকারি কলেজ, পটুয়াখালী