সাংবাদিক সাগর-রুনি হত্যাকান্ডের তদন্তে র্যাবের বর্থতা, নতুন টাস্কফোর্স গঠনের আদেশ
খোশ আমদেদ মাহে রমজান এবং বর্তমান অবস্থায় আমাদের করণীয়
মোঃ হাবিবুর রহমান:
পৃথিবীতে বিভিন্ন গ্রন্থ ও পুস্তিকা রয়েছে যার শুরুতেই প্রণেতা কর্তৃক ভুল থাকতে পারে বলে সংশয় ও দুঃখ প্রকাশ করা হয়। কিন্তু এমন একটি কিতাব আমাদের নিকট রয়েছে যার মধ্যে কোন সন্দেহ বা কপটতার অবকাশ নেই বলে ঘোষণা করা হয়েছে। আর সেটা হলো মহা গ্রন্থ আল কুরআন। মহান সৃষ্টিকর্তা বলেন, “এটা সেই কিতাব, এতে কোন সন্দেহ নেই, মুত্তাকিদের জন্যে ইহা পথ নির্দেশ (আল কুরআন, ২:২)”। কুরআন মূলত মানব জাতির জন্যে অনুগ্রহ, ও পথ প্রদর্শক স্বরুপ। মহান প্রভূ বলেন, “কুরআন তোমাদের প্রতিপালকের নিদর্শন, বিশ্বাসি সম্প্রদায়ের জন্যে এটা হিদায়ত ও রহমত”। পবিত্র কুরআনে মানব জাতির জন্যে বিভিন্ন বিষয়ে দিক নির্দেশনা রয়েছে, যা আমাদের চলার পাথেয় হিসেবে কাজ করে। মানবতা ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় এর অবদান অপরিসীম।
পৃথিবী সৃষ্টির দিন হতে আল্লাহর বিধানে বারটি মাস নির্দিষ্ট রয়েছে। তন্মধ্যে রমযান মাস মানব জাতির জন্য রহমতস্বরুপ। কারণ এ মাসে পবিত্র কুরআন নাযিল হয়েছে। পবিত্র রমযান মাসে রহমত, মাগফেরাত ও নাযাত লাভের সুযোগ রয়েছে। পরিপূর্ণভাবে নামায পড়া, কুরআন বুঝে পড়া, কথায়-কাজে মাধুর্যতা প্রকাশ ও ভাল ব্যবহার প্রদর্শনের মাধ্যমে আমরা নিজেদেরকে নতুনভাবে গড়ে তুলতে পারি। এ মাসের শিক্ষাই বাকি ১১ মাস আমাদের সঠিক পথে চলতে সাহায্য করবে।
ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভ রয়েছে। এ পাঁচটি খুঁটির মধ্যে রমজান অন্যতম। এটি মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে বিরাট নেয়ামত ও অনুগ্রহ। প্রত্যেক প্রাপ্ত বয়স্ক, মুকিম মুসলমান ও সুস্থ মস্তিষ্ক ব্যক্তির উপর রোযা রাখা আবশ্যক। তবে পাগল, মুসাফির, পিরিয়ড বা মাসিক চলাকালিন নারীদের, ও নাবালেগ ব্যক্তিদের উপর রোযা আবশ্যক নয়। উপরন্তু রোযা যাদের উপর আবশ্যক নয়, পরবর্তীতে ব্যক্তি বিশেষে ও নির্দিষ্ট নিয়ম অনুযায়ী তা আদায় করে নিতে হয়। এছাড়াও অক্ষম ও অসুস্থ ব্যক্তিদের জন্যে ইসলাম অবস্থাভেদে রোযা রাখার ব্যাপারে সহজ বিধান করে দিয়েছেন। রোযা মূলত সুবহে সাদিক হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও স্ত্রীর সাথে অন্তরঙ্গ মূহুর্ত কাটানো বা সহবাস হতে বিরত থাকাকে ইসলামের দৃষ্টিতে সিয়াম বা রোযা বলা হয়।
রোযা রাখা পূর্ববর্তী জাতির উপর আবশ্যক ছিল এবং আমাদেরকে মুত্তাকি হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। হযরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত সকল নবী ও রাসূল রোযা পালন করেছন। যদিও তা ধারাবাহিক ও সংখ্যাগত দিক থেকে বেশ পার্থক্য ছিলো। আসমানি কিতাব, সহিফা, ঐশী বাণী ও হাদিস শরীফে এ ব্যাপারে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, “হে মুমিনগণ! তোমাদের জন্য রোযার বিধান দেয়া হলো, যেমন বিধান তোমাদের পূর্ববর্তীগণকে দেয়া হয়েছিল,- যাতে তোমরা মুত্তাকি হতে পারো (আল কুরআন, ২:১৮৩)”। এছাড়াও পৃথিবীর অন্যান্য জাতির মধ্যে ইহুদি, খ্রিষ্টান, বৈদ্ধ, জৈন ও হিন্দু সম্প্রদায় তাদের ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী উপবাস থাকে। তবে তাঁদের উপবাস-এর ধরন মুসলিম ধর্মের রোযার চেয়ে আলাদা, ও স্বতন্ত্র।
রোযা রাখার বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক ও স্বাস্থ্যগত সুবিধা রয়েছে যা বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণাতে প্রমাণিত হয়েছে। রোযা রাখার কারণে মস্তিষ্কের স্নায়ু কোষগুলোর বৃদ্ধি, হরমোন বৃদ্ধি, বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন সমস্যা দূর, চর্বি কমাতে সহায়তা, ওজন কমানো, ও ডায়াবেটিকস-এর ঝুঁকি কমে যায়। যদিও এ ক্ষেত্রে ডাক্তারি পরামর্শ অনুযায়ী ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে তা পালন করা আবশ্যক। উল্লেখ্য যে, পানি শূন্যতা দূর করাসহ অন্যান্য সমস্যা এড়িয়ে চলতে সেহরি ও ইফতারিতে মান সম্মত খাবার ও পরিমিত খাবার খাওয়া প্রয়োজন।
যাকাত ইসলামের অন্যতম একটি স্তম্ভ। প্রত্যেক প্রাপ্ত বয়স্ক ও বিবেক বুদ্ধি সম্পন্ন মুসলিম সামর্থবান তথা যার নিকট সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ, অথবা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্য বা সম পরিমাণ মূল্য বা টাকা ঐ ব্যক্তির এক বছরের যাবতীয় ব্যয় নির্বাহের পর উপর্যুক্ত পরিমাণ অর্থ সঞ্চয় থাকলেই তাকে যাকাত দিতে হবে। এছাড়াও সামর্থবান ব্যক্তিদের জন্যে গোপনে ও প্রকাশ্যে অপরকে দান ও সহযোগিতা করার ব্যাপারে মহাগ্রন্থে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। মহান রিযিকদাতা বলেন, “ আমার বান্দাদের মধ্যে যারা মুমিন, তাদেরকে তুমি বল, সালাত প্রতিষ্ঠা করতে এবং আমি তাদেরকে জীবিকা হিসেবে যা দিয়েছি তা হতে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করতে-সেই দিনের পূর্বে যে দিন ক্রয়-বিক্রয় ও বন্ধুত্ব থাকবে না (আল কুরআন, ১৪:৩১)”।
যাকাত প্রদানের মাধ্যমে মূলত ব্যক্তির ধন-সম্পদ বৃদ্ধি পায়। আর এটার অন্যতম দার্শনিক দিক হলো সাধারণ ও অসহায় মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ার মাধ্যমে অর্থনৈতিক গতিশীলতা বাড়ে। বিশ্ব জাহানের নিয়ন্ত্রক বলেন, “ মানুষের ধনে বৃদ্ধি পাবে বলে তোমরা যে সুদ দিয়ে থাক, আল্লাহর দৃষ্টিতে তা ধন- সম্পদ বৃদ্ধি করে না। কিন্তু আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্যে যে যাকাত তোমরা দিয়ে থাক, তাই বৃদ্ধি পায়, তারাই সমৃদ্ধশালী (আল কুরআন, ৩০:৩৯)”। সতুরাং এ মহামারীতে আমাদের অন্যের বিপদে সহযোগিতার ও সহমর্মিতার হাত প্রসারিত করা উচিত।
মানুষ সাধারণত নেতিবাচক দিকটা বেশি প্রচার করে। তুলনামূলকভাবে আমাদেরকে অনেক অসচেতন বলা হলেও এ দেশের মানুষ পৃথিবীর অন্যান্য জাতির তুলনায় একে অপরের বিপদে এগিয়ে আসছে। এ মহামারীর কারণে মানুষ একে অপরের দুঃখ দুর্শশা বোঝার চেষ্টা করছে। প্রকাশ্যে ও গোপনে স্বেচ্ছাসেবামূলক কার্যক্রম পরিচালনা, পরোপকারিতা, অপরের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করছে। যা সত্যিই আমাদের জন্যে বড় পাওয়া ও গর্বের বিষয়। অর্থনৈতিক স্বচ্ছল ও অস্বচ্ছল নির্বিশেষে সবাই এ বিপদে অসহায় মানুষদের সহযোগিতা করছে। তবে সমাজের বিত্তবান ও সামর্থবান মানুষদের ইহকালিক ও পরকালিন মঙ্গল ও সমৃদ্ধি লাভের জন্যে আরও সমাজ এবং আর্ত মানবতার সেবায় অবদান রাখা উচিত। আমাদের ভাল কাজ করার অন্যতম তাত্ত্বিক ও দর্শনগত দিক হলো- ভাল থাকা ও ভাল কাজ করার মাধ্যমে ইহকালিন প্রশান্তি ও মানবিক হওয়ার পাশাপাশি পরকালিন মুক্তি পাওয়া যাবে। মাহে রমযানের পবিত্রতা রক্ষার্থে বাজারের সিন্ডিকেট দূর করা ও কারসাঁজি পরিহার, খাদ্যে ভেজাল না দেওয়া, ওজনে ঠিক দেয়া, অশালিন কর্মকাণ্ড থেকে মুক্ত থাকা দরকার। ফলত, এর মাধ্যমে আমরা মাহে রমযানের শিক্ষা লাভ করে একটি সুখী সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলতে পারি। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রাখা, কালোবাজারি ও মজুদদারি রোধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বাজার তদারকি ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
লেখকঃ বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক