হাইকোর্টে চ্যালেঞ্জ: বিয়ের প্রলোভনে শারীরিক সম্পর্কের শাস্তি কি বাতিল হবে?
বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতা: আইন আছে বিচার নেই
বিশেষ প্রতিবেদন, ঢাকা
মোছা. শাকিলা শারমিন
বাংলাদেশে ৯০ দশকের পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত রাষ্ট্রপ্রধান নারী হলেও নারীর প্রতি সহিংসতা থেমে থাকেনি। বিভিন্ন উপায়ে বেড়েই চলেছে নারী নির্যাতন। কোনো নারী প্রতারণার মাধ্যমে ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন, আবার হয়তো কোনো নারীকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ করা হচ্ছে, কেউ হয়তো সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। এ ব্যাপারে মামলাও হচ্ছে। কিন্তু আইনের ফাঁক-ফোকর দিয়ে অপরাধী বেরিয়ে যাচ্ছেন।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুসারে, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ২০২৩ সালে সারাদেশে শুধু থানায় ১৮ হাজার ৯৪১টি মামলা হয়েছে।
ভুক্তভোগী এক নারী জানান, তিনি প্রতারণার মাধ্যমে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। তিনি অভিযোগ করে বলেন, পরিচিত এক বাসচালক তাকে গাজীপুর থেকে রংপুরের বাসে তুলে দেওয়ার কথা বলে বাসায় নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুই নারী জানান, বিয়ের কথা বলে তাদের ধর্ষণ করা হয়েছে। আরেক নারী জানান, তিনি স্বামীর সঙ্গে ঘুরতে গিয়ে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। স্বামীকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে তাকে ধর্ষণ করা হয়।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুসারে, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ২০১৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ১৬ থেকে সাড়ে ২২ হাজার মামলা হয়েছে। মূলত নারী নির্যাতনের ঘটনায় মামলা হলে তা পুলিশের পরিসংখ্যানে আসে। এছাড়া আদালতেও মামলা হয়। থানায় যত মামলা হয়, তার প্রায় ১০ শতাংশের সমপরিমাণ আদালতে হয় বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, এখন নাগরিকদেরও নারী নির্যাতন প্রতিরোধে সচেতনতা তৈরির কাজে নামতে হবে। সরকার নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সব সময় সোচ্চার। যখন যে ঘটনা ঘটছে, পুলিশ ব্যবস্থা নিচ্ছে। এখন গণমাধ্যমকেও সচেতনতা সৃষ্টিতে ভূমিকা নিতে হবে। যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা কেন নারীদের ধর্ষণ করেছে? কেন তাদের বিচার হচ্ছে না? কেন তাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে না? এসব প্রশ্ন তিনি এড়িয়ে যান।
অনলাইনেও নারীরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। পুলিশ সাইবার সাপোর্ট সেন্টার ফর উইমেনের (পিসিএসডব্লিউ) তথ্য অনুসারে, গত ১৫ মাসে অনলাইনে ভুয়া আইডি (পরিচয়) খোলা, আইডি হ্যাক, প্রতারণা, মুঠোফোনে হয়রানি এবং আপত্তিকর কনটেন্ট ছড়ানোর সাড়ে ১২ হাজারের বেশি অভিযোগ এসেছে।
‘জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা’র মাধ্যমে দরিদ্র নারী-পুরুষ, শ্রমিক এবং কারাবন্দীদের আইনি সহায়তা দিয়ে থাকে আইন মন্ত্রণালয়। সংস্থাটির ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রতিবেদন অনুসারে, ওই বছর সারাদেশে ৩২ হাজারের বেশি মামলায় সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। তবে সেখানে নারীর জন্য কতটা সহায়তা দেওয়া হয়েছে, তা আলাদা করে বলা নেই।
ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের (ওসিসি) তথ্য বলছে, গত ২৩ বছরে সেখান থেকে শারীরিক ও যৌন নির্যাতন এবং দগ্ধ হওয়ার ঘটনায় ৬২ হাজারের বেশি নারী ও শিশু সহায়তা পেয়েছে। মামলা হয়েছে মাত্র ১৯ হাজার ৪৪১টি। এর মধ্যে মাত্র ৩ শতাংশ ক্ষেত্রে রায় হয়েছে এবং সাজা কার্যকর হয়েছে ১ শতাংশের কম।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য বলছে, গত বছর ধর্ষণের শিকার হন ৫৭৪ জন এবং আরও ৩৩ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। স্বামীর হাতে খুন হন ২০৭ জন এবং আরও ৬৪ জনকে হত্যা করা হয়েছে যৌতুকের কারণে। একই কারণে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১৪২ জন নারী। যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন ১৪২ জন ও অ্যাসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন আরও ১০ জন। নারী নির্যাতনের কথা জানিয়ে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯–এ গত বছর তাৎক্ষণিক অভিযোগ এসেছে ২৬ হাজার ৭৯৭টি।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে মামলার জট কমাতে বিচারপ্রক্রিয়ায় আমূল পরিবর্তন আনা দরকার। পাবলিক প্রসিকিউটর রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ না দিয়ে ক্যাডার সার্ভিস থেকে ধাপে ধাপে নিয়োগ দিতে হবে।
তিনি আরও বলেন, কঠোর সাজার ভয়ে লোকে অপরাধ করবে না, এই ভাবনা থেকে কোনো কোনো অপরাধের শাস্তি বাড়ানো হয়। এর ফলে বিচারকের আসামিকে দোষী সাব্যস্ত করার হার কমে। কারণ, বিচারক মনে সামান্য সন্দেহ রেখেও বড় সাজা দিতে চান না। দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে বিষয়টিও বিবেচনায় রাখা দরকার।
জনবার্তা/এসপি