সাংবাদিক সাগর-রুনি হত্যাকান্ডের তদন্তে র্যাবের বর্থতা, নতুন টাস্কফোর্স গঠনের আদেশ
মধ্যপ্রাচ্যে নতুন ভোর: মিথ নাকি বাস্তবতা!
জ্যাক পারভেজ রোজারিও:
মধ্যপ্রাচ্যে নতুন ভোর- তর্কসাপেক্ষে বর্তমান বিশ্বের অন্যতম ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মুখে এমন বচন শুনে কিছুটা নড়েচড়ে বসতে হয় বৈকি। আন্তর্জাতিক রাজনীতির মাঠে একের পর এক চমকপ্রদ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্ব রাজনীতি থেকে প্রায় আলাদা করে ফেলা মার্কিন প্রেসিডন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার নিজ ভাবমূর্তিকে রক্ষা করার অভিপ্রায়ে এবং আসন্ন মার্কিন নির্বাচনের খেলায় আরো একবার জয়ী হতে বিশ্বের সামনে নিয়ে এসেছিলেন “ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি” খ্যাত মধ্যপ্রাচ্য চুক্তি। মূলত সেপ্টেম্বর মাসের ১৫ তারিখ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ভবন হোয়াইট হাউসে মধ্যপ্রাচ্যের তৃতীয় ও চতুর্থ দেশ হিসেবে সংযুক্ত আরব-আমিরাত ও বাহরাইন ইস্রায়েলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ঘোষণা এবং চুক্তি সম্পন্ন করে। বিশ্ব রাজনীতিতে হইচই ফেলে দেওয়া এই ঘটনাকে The New York Times এর বিখ্যাত কলামিস্ট টমাস এল ফ্রিডম্যান আখ্যায়িত করেছেন “মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক ভূমিকম্প”(Geo-Political Earth quack of Middle East) হিসেবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইস্রায়েল বরাবরের মতই এটিকে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা বলে ঘোষণা করেছে। মিশর, জর্ডানের মত রাষ্ট্রগুলো এ চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছে। তবে, এই পরিস্থিতিতে বিশ্ব রাজনীতির একটি পক্ষ বিশেষ করে ইরান এবং তুরস্কের মত রাষ্ট্রের মুখ দিয়ে অস্ফুট স্বরে বের হচ্ছে, “মধ্যপ্রাচ্যে হচ্ছে টা কী”?
আমাদের অবশ্য জেনে রাখা প্রয়োজন – ১৯৪৮ সালে ইস্রায়েল স্বাধীনতা লাভ করার মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্য সমস্যার শুরু। ইস্রায়েল রাষ্ট্রের জন্মলগ্ন থেকেই ফিলিস্তিনি জনগণ দাবি করে আসছে, ইস্রায়েলীয়রা জোরপূর্বক ভূমি দখলের মাধ্যমে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের ভূমিতে ইস্রায়েল নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে। ইস্রায়েল বরাবরই তাতে কর্ণপাত করেনি এবং বর্তমানে সে দাবিকে অনেকটা মায়া কান্নাতে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছে বলে কিছু কিছু রাজনৈতিক বিশ্লেষক ধারণা করছেন। লক্ষ্য করা প্রয়োজন, ১৯৭৯ সালে ইস্রায়েলকে মিশরের স্বীকৃতি প্রদানের পূর্ব পর্যন্ত আরব রাষ্ট্রগুলো সম্মিলিতভাবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ইস্রায়েলের বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছিল। পরবর্তীতে মিশর এবং জর্ডান যথাক্রমে ১৯৭৯ সালে ও ১৯৯৪ সালে ইস্রায়েলকে স্বীকৃতি প্রদান করে যা আরব বিশ্বের সম্মিলিত লড়াইয়ের জন্য ছিল এক প্রকার চপোটাঘাত এবং সেই স্বীকৃতি লড়াইয়ের মাত্রাকে কিছুটা হলেও বিবর্ণ করে দিয়েছিল। আর সেই দলে সর্বশেষ সংযোজন হচ্ছে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন। মধ্যপ্রাচ্যের রাজীতিতে আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে ইরানের উত্থানকেই উক্ত চুক্তির পিছনে মূল অনুঘটক হিসেবে ধরা হচ্ছে যদিও ইস্রায়েল-আমিরাত বলছে ভিন্ন কথা।
এই মুহুর্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধ থাকা সত্ত্বেও আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে ইরান সামরিক দিক দিয়ে যেভাবে দুর্দন্ডপ্রতাপে অগ্রসর হচ্ছে তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইস্রায়েল এবং দীর্ঘদিন অন্যায় ভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকা আরবের রাজপরিবারগুলোর জন্য সত্যিকারের হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। তাই মূল প্রশ্ন হচ্ছে, ঠিক এই সময় এই চুক্তিটি কেন? এটা কি বাস্তবিকই মধ্যপ্রাচ্যের জন্য নতুন ভোর নাকি শুধুই মিথ মাত্র!
উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমাদের যে বিষয়ে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন সেটি হচ্ছে মূলত এই চুক্তিতে কোন রাষ্ট্রগুলো থাকছে এবং কেন থাকছে। আপাতদৃষ্টিতে “Abraham Accord” নামক এই চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত রাষ্ট্র ৪ টি (মার্কিন যুক্তিরাষ্ট্র, ইস্রায়েল, আরব-আমিরাত ও বাহরাইন) হলেও মিশর, জর্ডান, সৌদি আরব, মরক্কোর মত গোটা মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি রাষ্ট্রের স্বার্থ এতে জড়িত রয়েছে। মিশর এই চুক্তিকে ইতিমধ্যেই স্বাগত জানিয়েছে কেননা এই চুক্তি ইস্রায়েলের সাথে মিশরের ১৯৭৯ সালের করা চুক্তিকে বৈধতা দিয়েছে। আবার লিবিয়া এবং ভূমধ্যসাগরে সম্প্রতি তুরস্কের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টার ব্যাপারে মিশর ইতিমধ্যেই উদ্বিগ্ন। এছাড়াও তুরস্ক মিশরে নিষিদ্ধ ঘোষিত মুসলিম ব্রাদারহুডকে সমর্থন দিয়ে থাকে। সুতরাং উক্ত চুক্তি লিবিয়াতে তুরস্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আরব আমিরাত-মিশরের হাতকে শক্তিশালী করবে।
মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম দেশ জর্ডান এই চুক্তিতে লাভবান হবে সবচেয়ে বেশি। কেননা এই চুক্তিটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের আশা বাঁচিয়ে রাখবে। ১৯৪৭-৪৮ যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে জর্ডান একটি বিশাল জনসংখ্যার ফিলিস্তিনি শরণার্থী বয়ে বেড়াচ্ছে। স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে জর্ডানকে উক্ত শরণার্থীদেরকে বয়ে বেড়াতে হবে না যা তার অর্থনীতির জন্য স্বস্তিদায়ক। এর পাশাপাশি নিরাপত্তার স্বার্থ তো রয়েছেই।
তবে আমাদের জানতে হবে, উক্ত চুক্তির অন্তর্নিহিত তাৎপর্য আরো গভীরে। ইস্রায়েলের সাথে আরব আমিরাত বা বাহরাইনের মত দেশগুলোর চুক্তির আপাত প্রতীয়মান কারণগুলো বিনিয়োগ, পর্যটন, ফ্লাইট চলাচল, টেলিযোগাযোগ, জ্বালানি, স্বাস্থ্যসেবা, সংস্কৃতি বা পরিবেশবিষয়ক হলেও অন্তর্নিহিত কারণ হচ্ছে সামরিক নিরাপত্তা ইস্যু। মূলত মধ্যপ্রাচ্যে যেসব রাষ্ট্রগুলো আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বলয়ে আছে বা থাকতে চায় তাদের প্রত্যেকের সাধারন শত্রু হচ্ছে ইরান। একইসাথে মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলো ইতিমধ্যে বুঝতে পেরেছে যে “দুই রাষ্ট্রভিত্তিক” সমাধান চাইলে ইস্রায়েলের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের চেয়ে বিকল্প খুব বেশি উপায় নেই। এমনকি ইস্রায়েলের ভূমি সম্প্রসারণ ক্ষুধা কে এখনই থামাতে হলে উক্ত চুক্তির বিকল্প নেই। আঞ্চলিক শত্রু ইরানকে রুখতে হলে যে অত্যাধুনিক সামরিক অস্ত্র প্রয়োজন তা পেতে হলেও যুক্তরাষ্ট্রের মন গলানো ছাড়া বিকল্প নেই। আর তাই উক্ত চুক্তিভুক্ত মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলোর কাছে এই চুক্তিটি যতটা না ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষার জন্য তার চেয়ে ঠিক দ্বিগুন তাদের নিজেদের স্বার্থ রক্ষা এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই চুক্তিকে দেখছেন তার বিরাট কূটনৈতিক সাফল্য হিসেবে যার উপরে ভর করে তিনি নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চাচ্ছেন। আসন্ন মার্কিন নির্বাচনে বিভিন্ন ইস্যুতে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বেশ বেকায়দায় আছেন যা কিনা তাকে খাদের কিনারায় ফেলে দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ভালো করেই জানেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে ইহুদি লবিস্টরা কতটা গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক হিসেবে বিবেচিত। তাই, তাঁর কাছে এটি একটি বিশাল সুযোগ। আর ইস্রায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর কাছে উক্ত চুক্তি তার প্রধানমন্ত্রিত্ব রক্ষার অন্যতম কবচ। দূর্নীতি ইস্যুতে প্রতিদিনই তাঁর বিপক্ষে এই লকডাউনের মধ্যেও হাজার হাজার লোকের সমাবেশে আন্দোলন হচ্ছে। উক্ত চুক্তি তাঁকে এ যাত্রায় বাঁচিয়ে দিতে পারে বলে বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন। সুতরাং পক্ষ ভুক্ত প্রত্যেকটি রাষ্ট্রের নিকটই এই চুক্তি তার নিজ স্বার্থ রক্ষায় মহামূল্যবান। আপাতদৃষ্টিতে, ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বার্থ এখানে গৌন। তবে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে উক্ত চুক্তির সবচেয়ে বড় সাফল্য হচ্ছে অনমনীয় ইস্রায়েলকে পশ্চিম তীরে নতুন করে বসতিস্থাপন বন্ধ করতে রাজি করানো যা দুই রাষ্ট্রভিত্তিক স্বাধীনতার স্বপ্নকে এখনও বাঁচিয়ে রেখেছে।
মধ্যপ্রাচের রাজনীতিতে এই নাটকীয় পরিবর্তন প্রকৃতপক্ষেই কি মধ্যপ্রাচ্যের জন্য নতুন ভোর নাকি শুধুই একটি মিথ (রূপকথার গল্প) তা হয়তো সময়ই বলে দিবে। আপাতত আমাদের চোখ রাখতে হবে ইস্রায়েল ঠিক কতদিন পর্যন্ত এই চুক্তিকে সম্মান করে। কেননা, সমস্ত অন্ধকারের উৎস যার হাতে, অন্ধকার দূর করে দিয়ে ভোরের আলো ফোটানোর ক্ষমতাও তার হাতেই। বাকিরা দর্শক মাত্র!
লেখক: প্রভাষক (রাষ্ট্রবিজ্ঞান); বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা)
সহায়ক আর্টিকেলঃ
- Five reasons why Israel’s peace deals with the UAE and Bahrain matter; Jeremy Brown; 14 September 2020; BBC
- Welcome to a Brand-New Middle East; Varsha Koduvayur, David Daoud; 30 September 2020; FP
- ‘Historic’ Israel deal won’t likely bring peace to the Middle East; Dov Waxman, University of California; 17 August 2020; theconversation.com
- Israel-UAE deal shows how the very notion of Middle East peace has shifted under Trump; Anne Gearan and Souad Mekhennet; 16 August 2020; washingtonpost.com
- Trump’s Middle East deal is good. But not that good; The Editorial Board; 16 September 2020; nytimes.com