অনলাইন শিক্ষায় দরকার ফ্রি ইন্টারনেট

তানিম ইশতিয়াকঃ প্রভাষক, পটুয়াখালী সরকারি কলেজ

তানিম ইশতিয়াকঃ

লকডাউনে মালয়েশিয়ার সব মোবাইল কোম্পানি প্রতিদিন ১ জিবি ফ্রি ইন্টারনেট দিয়েছে‍। জুনে লকডাউন তুলে নিলেও তারা গ্রাহকদের জানিয়েছে, এই ফ্রি অফার ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে‍। দেশটির টেলিকমিউনিকেশন ইন্ডাস্ট্রির এই দৈনিক জিবি অফারের উদ্দেশ্য শিক্ষাব্যবস্থা সচল রাখা ও অফিসিয়াল প্রোডাক্টিভিটি ধরে রাখা‍। হঠাৎ বন্ধে বাধ্য হলেও সবকিছু যেন একেবারে অচল না হয়, সেজন্য বিকল্প পথ খোলা‍। আবার কর্তৃপক্ষ সার্ভিস দিলেও টার্গেটগোষ্ঠীর জন্য যেন নাগালহীন না হয়, সেজন্য ফ্রি ইন্টারনেট‍।

ছবিঃ শিক্ষার্থীদের অনলাইন ক্লাশের সুবিধার্থে মালয়েশিয়ার একটি টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানীর ফ্রি ১ জিবি অফার

বাংলাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নতুন করে অন্তত ছয় মাসের সেশনজটের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে‍। প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষাজীবনে একবছরও পিছিয়ে যেতে পারে‍। করোনার তিন মাস পার হলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার মতো কোনো পরিস্থিতি নেই‍। লকডাউনের শুরুতেই মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের জন্য টেলিভিশনে দূরশিক্ষণ ও এটুআই সাপোর্টে অনলাইন ক্লাশ শুরু হয়েছিল‍। পর্যায়ক্রমে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় পুরোদমে চালু করলেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি‍। অন্যদিকে মাউশির নির্দেশনায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকারি কলেজগুলোতে অনলাইন ক্লাশ চালু হয়েছে‍।

অনলাইন ক্লাশের ব্যক্তিগত যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, তাতে এই প্রচেষ্টা খুব ফলপ্রসূ বলে মনে হচ্ছে না‍। এর বড় কারণ শিক্ষার্থীদের ইন্টারনেট সমস্যা‍। প্রায় সব শিক্ষার্থীই গ্রামের বাড়িতে অবস্থান করছে‍। পারিবারিক আয়-রোজগারের সঙ্কট ও খাদ্যস্বাস্থ্য সংক্রান্ত চাপ সামলাতেই ব্যস্ত তারা‍। এর মধ্যে উচ্চমূল্যে ইন্টারনেট কিনে ভিডিও ক্লাশে জয়েন করা বিলাসিতাই বটে‍। অল্পকয়েকজন যারা ফেসবুকে একটু সময় কাটায়, তাদের কাছেও লাইভ দেখার মতো এমবি থাকে না‍। শিক্ষকদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে, সম্মান দেখিয়ে বা শেখার আগ্রহে অনেকেই জয়েন করে বটে, বেশিক্ষণ যুক্ত থাকতে পারে না‍। মুহূর্তেই স্ক্রল করে অন্যকিছুতে চলে যায়‍। ফলে দেখা যায়, শিক্ষার্থী সংখ্যা এই তো ১৫ জন, মিনিটকয়েক পরে মাত্র ৩ জন! পরবর্তীতে ভিডিওগুলো যে খুব ভিউ হয়, তাও না‍।

শিক্ষকদের প্রযুক্তিগত সাপোর্ট, অনলাইন দক্ষতা, কোয়ালিটি কন্টেন্ট- এসব সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠলেও যাদের জন্য পরিশ্রম, সেই শিক্ষার্থীদের জন্য অনলাইন কার্যক্রম খুব কাজে আসছে না‍। এমনিতেই অনলাইনে পূর্ণ শিক্ষাকার্যক্রম সম্ভব না‍। ভার্চুয়াল টেস্ট, মূল্যায়ন বা হোমওয়ার্কের মতো উপাদান অনুপস্থিত থাকবে‍।

আজকের দুনিয়া যেখানে পৌঁছে গেছে, আমরা কেবল সেই পথে পা রেখেছি‍। এখন ক্লাউড-বেইসড ভার্চুয়াল ক্লাশরুম জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে‍। অনলাইন প্লাটফর্মেই পরীক্ষা ও মূল্যায়ন সহজ হয়ে গেছে‍। শিক্ষার এই টেকনোলজিক্যাল ট্রান্সফর্ম শিক্ষার্থীদের সেল্ফ-লার্নিংয়ে নিয়ে গেছে‍। সামনে এমন দিন আসছে, যখন বিশাল সংখ্যায় শিক্ষক নিয়োগের দরকার হবে না‍। বিভিন্ন অফিসিয়াল কাজে যেমন রোবট ব্যবহার করা হচ্ছে, তেমনি অনলাইন প্লাটফর্মের রেকর্ডেড ক্লাশই শিক্ষকের প্রয়োজন কমাবে‍। ফেস-টু-ফেস লেকচার, ওস্তাদের সান্নিধ্য, শাসন-বারণ এখন স্বাভাবিকভাবেই কমে যাবে‍। এটা একদিক দিয়ে সমস্যাজনক মনে হলেও প্রতিযোগিতার যুগে সেটাই সত্য ও সম্ভাবনা‍। যেকোনো মুহূর্তে শিক্ষককে নক করে সহায়তা গ্রহণের সুযোগ প্রযুক্তি করে দিয়েছে‍।

আমাদের সে ধরনের প্লাটফর্ম ও প্রযুক্তিগত অবকাঠামো না থাকলেও এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে হবে‍। বর্তমানের এই সঙ্কটমুহূর্তে পুরো শিক্ষাকার্যক্রম না চালাতে পারলেও অন্তত শিক্ষাদান অব্যাহত থাকতে পারে‍। সেজন্য দরকার সহজলভ্য ইন্টারনেট‍। শিক্ষার্থীরা একেবারে যাতে পাঠবিমুখ না হয়, চলমান জ্ঞানার্জনের ধারা থেকে যাতে বিছিন্ন না হয়; সেজন্য ফ্রি ইন্টারনেটের দাবি জানাচ্ছি‍। এই দুঃসময়ে এরকম সেবা দিতে মোবাইল কোম্পানিগুলোকে সরকার বাধ্য করতে পারে, অথবা আইসিটি বিভাগের সঙ্গে এ সংক্রান্ত চুক্তি করতে পারে‍। এই লেখাটি কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিগোচর হলে বিবেচনার অনুরোধ করছি।

লেখকঃ প্রভাষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান
পটুয়াখালী সরকারি কলেজ