করোনায় চুপসে গেছে নিম্ন আয়ের মানুষঃ বিত্তবানদের দ্রুত এগিয়ে আসা প্রয়োজন

লেখকঃ মোহাম্মদ এনায়েতুল্লাহ

করোনা শুধুমাত্র মানুষের মাঝে আতঙ্কই সৃষ্টি করেনি, সাথে অর্থনৈতিক ভাবে বিপদগ্রস্ত করে দিয়েছে নিম্ন আয়ের লোকদের। ‘দিনে এনে দিনে খাওয়া’ মানুষ, সাধারণ হকার, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমাজ করোনার আক্রোশে চুপসে গেছে। সাথে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত যারা সরকারী আধাসরকারী কিংবা নির্ধারিত চাকুরী করে না তারাও পড়েছে চরম বেকায়দায়।

কোথাও কাজ নেই, আয়-রোজগার নেই। এমন পরিস্থিতিতে কাজের সুযোগও নেই। কিন্তু খরচ আছে ঠিক আগের মতই। যারা দিন আনে, দিন খায়; কাজ না করলে একদিনও চলে না, তারা এখন দিশেহারা। আঁধার দেখছে কবে যাবে এই বৈশ্বিক মহামারি পরিস্থিতি। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় জনসমাগম বন্ধে পুলিশের কড়া পাহারা চলছে রাজধানীর সর্বত্র। ফলে বেকার হয়ে পড়েছে স্বল্প আয়ের অসংখ্য শ্রমজীবী মানুষ। হাত গুটিয়ে বসে আছে তারা। দোকানপাট, ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ। কোথাও কাজ নেই। এ পরিস্থিতিতে পেটে ভাত জোগাতে হিমশিম খাচ্ছে পরিবার পরিজন নিয়ে প্রতিনিয়ত।

গতকাল সরেজমিন রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে বেকার হওয়া সাধারণ মানুষের দুর্দশার চিত্র নজরে এসেছে। শ্রমিক, দিনমজুর, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, হকার, ঠেলাগাড়ি চালক, রিকশাচালক, মিন্‌তি, কয়ালরা চরম সংকটের মাঝে পড়েছে। প্রত্যক্ষ করা গেছে, দেশের বৃহত্তর স্বার্থে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সরকারকে কঠোর হতে হচ্ছে। কোনোভাবেই জনসমাগম না করা, সবকিছু বন্ধ করা, লকডাউন হওয়ায় স্বল্প আয়ের মানুষেরা এখন বেকার। এই সংকটকালে তাদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য সরকারি-বেসরকারি পর্যায় থেকে তেমন কোনো পদক্ষেপ এখনো শুরু হয়নি। তারা অনেকেই আশা করছে, খুব শীঘ্রই সরকার ও উচ্চবিত্ত মানুষেরা তাদের কথা ভাববে। নিম্ন-মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্তরা বিদ্যমান সংকটের ধকল কিছুটা সামলাতে পারলেও সীমিত আয়ের মানুষেরা হয়ে পড়েছে একদম উপায়হীন।

নিম্ন আয়ের মানুষদের পদভারে কোলাহলে থাকা আড়ৎ গুলোতেও চলছে একরকম সুনশান নীরবতা।
ঢাকার বাইরে থেকে কাঁচামাল বোঝাই ট্রাক আসছে না আগের মত। ঠেলাগাড়ি চালকরা ট্রাক থেকে নামানো মাল আড়তে পৌঁছে দিয়ে মজুরি পেয়ে থাকে। মাল না আসায় হাত গুটিয়ে বসে আছে তারা।

রাজধানীর কাওরান বাজারে গতকাল রাত ১১টায় একজন ঠেলাগাড়ি চালক বলেন, ‘ঢাকার বাইরে থেকে মালের ট্রাক আসা একেবারেই কমে গেছে। বাজারে পাইকার কম, ক্রেতাও কম। তাই কাজও কম। কখন একটা-দুইটা ট্রাক আসবে তার জন্য অপেক্ষা আমাদের। অনেকেই ঠেলাগাড়ি রেখে চলে গেছে।’

শ্রমজীবী মানুষের কথা- এই দুর্দিনে কেউ তাদের পাশে দাঁড়াবে, সহায়তার হাত বাড়াবে; এমন কেউ নেই। চলমান সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য সরকার, বেসরকারি খাতের সম্পদশালীরা, কোনো প্রতিষ্ঠান, সংস্থার আর্থিক সহায়তা তাদের জন্য খুবই জরুরি।

একই চিত্র রাজধানীর সর্বত্র। গতকাল থেকে সারাদেশ কার্যতঃ লকডাউন হওয়ায় রাজধানীর ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, স্বল্প পুঁজির হকার, কাঁচামাল ফেরী করা নিম্ম আয়ের লোকজন তাদের দিন শেষের প্রয়োজনীয় খাবারের অর্থটুকু রোজগার করতে না পেরে বিভিন্ন গলির মুখে, রেল পথের স্লিপারে কিংবা বন্ধ টঙ দোকানের বেঞ্চে মন খারাপ করে বসে থাকতে দেখা গেছে।

একজন রিকসা চালক জানালেন, আগের মতো খেপ পাওয়া যায় না। সকাল ৯টায় বের হয়ে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত পকেটে উঠেছে ২৮০ টাকা। আগে এই সময়ে কামাই হতো ৭শ’ থেকে একহাজার টাকা। স্ত্রী, দুই ছেলে, দুই মেয়ের সংসার চলবে কীভাবে- এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন তিনি।

আজ সকালের দিকে শান্তিনগর কাঁচাবাজার, খিলগাঁও কাঁচাবাজার, মালিবাগ বাজার ও পল্টন ঘুরে দেখা গেছে স্বল্প মাত্রায় কিছু মুদি ও কাঁচা মালের দোকান খুললেও ক্রেতা সমাগম একেবারেই কম। অধিকাংশ দোকানদার ক্রেতা কম বিধায় মালামাল আনছে না বা আনলেও খুব কম পরিমাণে। বাজারে ক্রেতা না আসায় মিন্তি-কুলি, দোকানে খেটে খাওয়া স্বল্প আয়ের লোকজনের কপালে চিন্তার ভাঁজ। শান্তিনগর বাজারের মিন্তি নুরু মিয়া মনখারাপ করে বললো, স্যার খেপ নাই, পরিচিত স্যার’রা কেউ বাজারে আসছে না। কিছু কিনলে আমাকে নিয়েন স্যার। নুরু মিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে আমার নিজেরও খুব মন খারাপ হলো। তেমন কিছু কেনার নাই বলে নুরু মিয়ার হাতে ৫০ টাকার একটি নোট গুঁজে দিয়ে বাজার ত্যাগ করলাম।
বিশ্ব ব্যাপী আগ্রাসী এ নবেল করোনা ভাইরাস আমাদের মত অনুন্নত দেশের শ্রমজীবী মানুষের জন্য এক মহা বিপদ ডেকে এনেছে। এমতাবস্থায় সরকার ও সমাজের সামর্থবান লোকদের দ্রুত এগিয়ে আসা প্রয়োজন এই খেটে খাওয়া মানুষদের পাশে।

লেখকঃ নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক নয়া দেশ