মৌলবাদী সমাজে কি নারীবাদ প্রতিষ্ঠা পাবে?

প্রতীকী ছবি

মতামত 

শাকিলা পাতা (এসপি)|

মৌলবাদ

মৌলবাদ (Fundamentalism) হচ্ছে ধর্মীয় মতবাদগুলোর কঠোর অনুগমনের চাহিদা। যারা প্রত্যেকটি বিষয় ধর্মীয় নিয়ম-কানুন, রীতি নীতি ও দিকনির্দেশনা অনুযায়ী বিবেচনা করে। কোন বিষয়কে ধর্মীয় আদর্শের সঙ্গে সংমিশ্রণ ঘটানোর চেষ্টা করা বা সে অনুযায়ী নিজের বিশ্বাস প্রতিষ্ঠার জন্য চরমপন্থা বা গোড়ামি অবলম্বন করা হলো ধর্মীয় মৌলবাদ। মৌলবাদ শব্দটির সাধারণ অন্য অর্থ হলো মূলজাত। এখানে মূল শব্দটি দ্বারা ধর্মকে বোঝানো হচ্ছে।

ইসলাম ধর্মে মৌলবাদের উত্থান ইরানে। ৯০ দশকে সমাজতান্ত্রিক ধারাকে বিলোপ করার লক্ষ্যে পুঁজিবাদী শক্তি ইসলামি মৌলবাদের শিকড়ে রসের জোগানদার হয়ে ওঠে। পরবর্তী সময়ে ইসলামি মৌলবাদ সারা দুনিয়ায় মাথাচারা দিয়ে ওঠে। এরা ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে না, এদের মূল লক্ষ্য ক্ষমতা প্রয়োগ। পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের অর্থনীতির ভঙ্গুরতার জন্য দায়ী মৌলবাদীদের ক্ষমতার রাজনীতি। আইএস, আল-কায়দা, বাংলাদেশে বাংলা ভাই, হিজবুত তাহরি, জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলামসহ কিছু সংগঠন যারা সামাজিক শান্তির চরম অবনতি ঘটাচ্ছে। এদের হাতে নারীরা শুধুমাত্র সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র আর পুরুষের ভোগ্য পণ্য। বাংলাদেশের মৌলবাদী শক্তি পাকিস্তান, আফগানিস্তানেরতালেবান দ্বারা প্রভাবিত। সেসব দেশে যেভাবে নারীদের ঘরবন্দি করে রাখা হয়, বাংলাদেশেও মৌলবাদী শক্তি নারীদের একইভাবে ঘরবন্দি করে রাখছে।

নারীবাদ

পুরুষকেন্দ্রিক শাসনের জাঁতাকলে পিষ্ঠ হয়ে নারীরা যখন প্রতিবাদী হয়ে ওঠে, তখন নারীর এই প্রতিবাদী রূপটি নারীবাদ হিসেবে অভিহিত হয়।নারীবাদ শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ Feminism। এ শব্দটি এসেছে ফরাসি শব্দ থেকে। Femme শব্দটির অর্থ নারী, isme শব্দটির অর্থ মতবাদ। নারীবাদ একটি আন্দোলন যা নারীর ক্ষমতায়ন, ভোটদানের অধিকার এবং নারী-পুরুষ সমান এই দাবি থেকে শুরু হয়।

ইসলামি মৌলবাদী শক্তি নারীদের যেভাবে দেখতে চায়

মূলত সব ধর্মেই মায়ের মর্যাদার কথা বলা হয়েছে। ইসলাম ধর্মেও মায়ের মর্যাদাকে সবার উপরে স্থান দেওয়া হয়েছে। তবে আলেম সমাজ কোরআন হাদিস দিয়ে নারীকে নানাভাবে ঘরবন্দি করে রাখতে চায় যা তাদের মৌলিক মানবাধিকারের লঙ্ঘন। মূলত আলেম সমাজ যেসব বক্তব্য প্রচার করেন এবং নারীকে যেভাবে রাখতে চান-

● স্ত্রীর ওপর স্বামীর আধিপত্য বিস্তার। এই কারণে আল্লাহ পুরুষকে নারীর চেয়ে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন (সুরা নিসা: আয়াত ৩৪)। এর মাধ্যর পুরুষ নারীর উপর তার শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করে, নারীকে নগণ্য হিসেবে মনে করে। সেইসাথে আলেম সমাজ ওয়াজ মাহফিলে এসব কথা বলে নারীর অধিকার ও কথা বলার স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করেছেন। ফলে আমাদের সমাজে নারীরা নিজেদের প্রমাণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

● স্ত্রীরা হচ্ছে শস্যক্ষেত্র, ফলে তোমরা ইচ্ছেমতো তাদেরকে ব্যবহার করতে পারো। (সুরা বাকারা আয়াত : ২২৩)। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর একটি জরিপ বলছে, বিবাহিত নারীদের মধ্যে শতকরা ৭২.৬ জন তাদের জীবদ্দশায় কখনো না কখনো স্বামীর দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। আর এই প্রথা আলেম ও ইসলামি মৌলবাদীরা কায়েম করেছেন।

● মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) বলেছেন, আমার পরে ইসলামি দ্বীন বিনষ্টকারীদের মধ্যে নারীরা সবচেয়ে বেশি হবে (বুখারী হাদিস)। এই হাদিস প্রচার করে আলেম সমাজ নারীদের ঘরের বাইরে বের হতে ও কাজ করতে অনুৎসাহিত করে।

● স্বামী যদি স্ত্রীকে শারীরিকভাবে মিলিত হওয়ার জন্য ডাকে, তাহলে স্ত্রী যে অবস্থায় থাকবে সে অবস্থায় স্বামীর কাছে গিয়ে তার ইচ্ছে পূরণ করবে। আর যদি অসম্মতি জানায়, তাহলে সারা রাত ফেরেশতাগণ লানত বা অভিশাপ করতে থাকবেন (হাদীস বাইহাকি)। নারীর যদি মাসিকের কারণে শরীর খারাপ থাকে, তাহলেও তাকে স্বামীর ডাকে সাড়া দিতে হবে। এটা একজন নারীর প্রতি পাশবিক এবং শারীরিক নির্যাতন। অনেক নারী স্বামীর এই যৌনতার শিকার হয়ে শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন।

● স্ত্রীর অবাধ্যতা দেখলে তাকে পৃথক রাখো, ঠিক না হলে তাকে প্রহার করো (সুরা নিসা : আয়াত ৩৪)। মৌলবাদী আলেম সমাজ বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ওয়াজ মাহফিল করে এই বক্তব্য দিয়ে পুরুষকে উসকে দিচ্ছে। ফলে স্বামী ও তার পরিবার দ্বারা প্রতিটি নারী কোনো না কোনোভাবে সহিংসতার শিকার হচ্ছেন।

● জাহান্নামিদের মধ্যে নারী হবে সংখ্যাগরিষ্ঠ (হাদিস বায়হাকী) যখন কোন মেয়ে স্কুলে কিংবা কলেজে যায় তখন এ কথা হরহামেশায় শোনা যায়, এই যে দোজখের খড়ি হেঁটে যাচ্ছে।

● নারী জাতিকে সৃস্টি করা হয়েছে পাজরের হাড় থেকে। ফলে নারীর স্বভাব বক্রতা (হাদীস মেশকাত শরীফ)। প্রথমত এই কথার বৈজ্ঞানিক কোনো ভিত্তি নেই। দ্বিতীয়ত নারীকে মৌলবাদী আলেমরা সমাজে হেয় করতে এসব বক্তব্য ছড়িয়ে যাচ্ছেন।

● নারীকে পর্দার মধ্যে থাকতে হবে। নারী করবে ঘরের কাজ আর পুরুষ করবে উপার্জন। (হাদীস)। এই চিন্তাধারা সমাজে এখনো বলবৎ রয়েছে। ফলে একজন নারী ইচ্ছে করলেই পুরুষের মতো ঘর থেকে বের হয়ে আসতে পারে না। এক্ষেত্রে তাকে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার শিকার হতে হয়।

এছাড়াও সমাজে শরীয়াভিত্তিক আইন প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। এই আইন দিয়ে বিচার শালিস হয়। এই আইনের বলে নারীকে সমঅধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। তাছাড়া এই আইন দিয়ে যেসব ফতোয়া জারি করা হয়-

● বিয়ের ব্যাপারে পুরুষ তার মতামত ব্যক্ত করতে পারেন কিন্তু নারীকে তার পারিবারিক সিন্ধান্ত মেনে নিতে বাধ্য করা হয়। এতে নারীর মত প্রকাশের অধিকার ক্ষুণ্ন হচ্ছে।

● পিতামাতার সম্পত্তি বণ্টনের ক্ষেত্রেও নারী-পুরুষ বৈষম্য রয়েছে। পুরুষ পাবে অর্ধেক কিন্তু নারী পাবে এক তৃতীয়াংশ। এখানে সমান অধিকার থেকে নারী বঞ্চিত।

● ইসলামী বিচার ব্যবস্থায় সাক্ষ্য প্রমাণের ক্ষেত্রে একজন পুরুষ এর সমান দুইজন নারী। এটা অনেক বড় মৌলবাদী প্রথা ও নারীর প্রতি অনাচারের শামিল।

● শরীয়া আইনে নারীর ব্যভিচারের ক্ষেত্রে চরম মাত্রায় শাস্তির বিধান রয়েছে। একজন ব্যভিচার করলে তাকে ১০০ বেত্রাঘাতের নির্দেশ রয়েছে আর নারীকে প্রস্তারাঘাতে মৃত্যুদণ্ডের কথা বলা হয়েছে।

● মৃত ব্যক্তির জন্য একজন পুরুষ তিন দিন বা তার অধিক শোক পালন করতে পারে। কিন্তু একজন নারীকে ৪ মাস ১০ দিন শোক পালন করতে হবে।

● শরীয়া আইনে বলা হয়েছে, দান খয়রাতের প্রথম হকদার স্বামী-সন্তান। এই নিয়ে ইমামগণ একমত হয়েছেন স্ত্রী, স্বামীর যাকাত-ফিতরা পাওয়ার অধিকারী নয়।

সুতরাং ইসলাম নারীকে সমান অধিকার দিয়েছে একথা সত্য নয়। মৌলবাদী আলেম সমাজ প্রকাশ্যে ওয়াজ মাহফিলের মাধ্যমে সমাজে অজ্ঞতা ছড়িয়ে নারীকে তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করছেন, নারীর ক্ষমতায়নে বাধার সৃষ্টি করছেন। যেসকল নারী এসব মৌলবাদী প্রথা থেকে বের হয়ে আসতে চাচ্ছেন, তাদেরকে নানা ধরনের জুলুম, নির্যাতন, ধর্ষণ, হত্যা, জীবননাশের হুমকি, হামলা-মামলা ও হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। নারীকে ঘরে-বাইরে সবখানে শারীরিক ও মানসিক অত্যাচারের সঙ্গে যুদ্ধ করে সামনে এগিয়ে যেতে হচ্ছে।

বাংলাদেশের ধর্মভিত্তিক দল নারীকে যেভাবে দেখতে চায়

জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ, হেফাজতে ইসলাম, হিজবুত তাহরিসহ ধর্মভিত্তিক সকল দলের নারীর প্রতি মনোভাব প্রায় একই রকম। উপরোক্ত আইন তাদের শাসন ব্যবস্থায় বলবৎ থাকবে। নারীদের তারা তালেবানি ও ইরানি শাসন ব্যবস্থার মতো পরিচালিত করতে চায়। তাছাড়া তাদের দলে নারী নেতৃত্ব নেই। নারী থাকবে ঘরে এই মূলমন্ত্রে তারা বিশ্বাসী। রাস্ট্র ক্ষমতায় গেলে তারা তাদের মৌলবাদী দর্শন প্রতিষ্ঠা করবে এমন বক্তব্য তারা হরহামেশা দিচ্ছেন। এমতাবস্থায় বাংলাদেশে নারী কিভাবে ঘর থেকে বের হয়ে উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাবে? তাই একথা বলা যায়, মৌলবাদী শাসন ব্যবস্থায় নারীবাদ প্রতিষ্ঠা অসম্ভব।

লেখকঃ মোছা. শাকিলা শারমিন
সাংবাদিক ও ব্লগার
shakilapata11@gmail.com